আমাদের পৌরাণিক ভ্রাতাগণ প্রায়শই ঈর্ষা ও বিদ্বেষবশত বৈদিকগণকে আব্রাহামিকদের [যবন কিংবা খ্রিষ্টমতালম্বী ] সাথে তুলনা করে থাকেন । তাদের এহেন বক্তব্যের কারণ হিসেবে কয়েকটি ব্যর্থ আরোপ তারা করে থাকেন যেমন - সাকারবাদ ও প্রতিমা অস্বীকার করা , স্থল-জলজ তীর্থ অস্বীকার, তথাকথিত পরম্পরা মান্য না করা ইত্যাদি । প্রকৃতপক্ষে তাদের সকল দাবিই মূর্খসুলভ ও অজ্ঞতাপ্রসূত । কেননা মূর্তিই একমাত্র উপায় বা একে না মানলে তা সনাতনের মধ্যে পড়বেই না এহেন যুক্তি কোন স্বাধ্যায়হীন অন্ধের পক্ষেই বলা সম্ভব । অবতারবাদ স্বীকার করার মধ্যেও এহেন কোন তাৎপর্য নেই । কেননা যাদের পরম্পরা অনুসারে এরা নিজেদের দাবি করে অধিকাংশই মায়াবাদী এবং মায়াবাদীরা নিজেদের সর্বোচ্চ ভেবে বাকিদের অধিকারীভেদে সত্য বললেও চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মোটেও স্বীকার করে না ।
অন্যদিকে অবতার শব্দটিই বেদে নেই । অবতারের কাহিনীও পরস্পর অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অযৌক্তিক । দেবতার দেহ নিয়ে পূর্ব মীমাংসাবাদী ও মায়াবাদীদের বিরোধীতাও বিদ্যমান । অপর দিকে বেদকে এরা মূল বলেও অপৌরুষেয় গ্রন্থকে বেদানুকূল প্রমাণ না মেনে বেদের সম মর্যাদা দান করে ৷ এসব বিষয়ে আমরা শীঘ্রই তাদের পরম্পরার বিরোধীতা ও পরস্পরবিরোধীতা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করবো ৷
আজকে আমরা প্রধানতঃ তারা যেসকল বিষয় না মানার পরিপ্রেক্ষিতে বৈদিকদের আব্রাহামিক বলে দাবি করে সেগুলোতে নিজেরাই আকণ্ঠ নিমজ্জিত সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবো -
১। পৌরাণিকগণ ঈশ্বর নিরাকার বলেও স্থান বিশেষে ঈশ্বর অপ্রাকৃত দেহধারণ করে কৈলাস, গোলক, বৈকুণ্ঠে আছে বলে দাবি করে ৷ অন্যদিকে আব্রাহামিকরাও তাদের সৃষ্টিকর্তা যিনি কিনা জগতের কোন প্রাণীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নন তিনি সাত আসমানের উপরে কোন আরশ নামক সিংহাসনে বসে আছে বলে দাবি করে । অতঃ সাকার দাবি করার দিক দিয়ে তাদের সাদৃশ্য বিদ্যমান ।
২। পৌরাণিকরা যেমন তীর্থ, দিবস ও ব্রত বিশেষে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি ও যত পাপই করুক না কেন সহজেই পাপমুক্ত হওয়া যাবে ও মুক্তি নিশ্চিত এই লালসা পুরাণাদিতে বিস্তার করেছে তেমনি আব্রাহিমকরাও মরুময় কোন স্থানে কিংবা মাস বিশেষে নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম পাপকাজের ক্ষমা হবে বলে দাবি করে ।
৩। পৌরাণিকদের মতে সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ ও ঐশ্বরিক জ্ঞান বেদের নারী ও শূদ্রের পঠন অধিকার নিষিদ্ধ করেছে ও শাস্তিরও বিধান দিয়েছে । অন্যদিকে আব্রাহামিকগণও তাদের তথাকথিত উপাস্যের উপাসক [ যেমন ঈমাম ] নারীরা হতে পারবে না বলে মত পোষণ করেছে ।
৪। আব্রাহামিকদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন মত আছে যেমন তাদের উপাস্য বা কে কিভাবে উপাসনা করবে, হাত বা নিচু হওয়া কতবার এসব নিয়ে তাদের বিভ্রান্তি ও মতভেদ আছে তেমনি পৌরাণিকদের মধ্যেও আছে । বৈষ্ণবরা যেমন মাংসাহারকে মুক্তির অন্তরায় মানে তেমনি শৈব বা শাক্ত্রা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিলেও পূজাতে অবশ্য কর্তব্য বলে মানে ।
৫। আব্রাহামিকরা তাদের সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করে । তেমনি পৌরাণিকরাও করে এবং এর যথাযথা নিয়েও তাদের পঞ্চমতে ভ্রান্তির পরে অধিকারী ভেদ বলে এড়িয়ে যায় কিন্তু কেউই চূড়ান্ত বলে তা মানে না । পশুবলি পঞ্চমতের একটি মতের অবশ্য কর্তব্য ও কখনোই পৌরাণিকরা তা ত্যাগ করতে বা অস্বীকার করতে পারবে না ।
৬। আব্রাহামিক ও পৌরাণিক উভয়ই অবৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী ও বিজ্ঞানে অবিশ্বাসী এবং স্বীয় গ্রন্থের অপব্যাখ্যা করে । তারা বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিরোধী ও অস্বীকার করে বা ক্ষেত্রবিশেষ গ্রহণ করে নিজেদের স্বার্থ পুষ্টি করে ।
৭। পৌরাণিকদের স্বর্গ নরক ও আব্রাহামিকদের বেহেশত - দোজখের মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান । যদিও পৌরাণিকরা চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে তা স্বীকার করে না কিন্তু তাদের মধ্যে এই সাদৃশ্যটি বিশেষ লক্ষ্যণীয় এবং পরস্পর এ বিষয়ে একমত । আব্রাহামিকদের বেহেশতে মদ্যাদি যেমন আছে তেমনি পৌরাণিকদের পুস্তক অনুযায়ী পৃথিবীতেই মদ্যাদির সমুদ্রের বর্ণনা বিদ্যমান ।
৮। পৌরাণিকদের ঈশ্বর ও দেবদেবীর মধ্যে মানবীয় দোষগুণের এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যধিক বেশী পরিমাণেই লক্ষ্য করা যায় । আব্রাহামিকদের সৃষ্টিকর্তার মধ্যেও এমন মনোভাব ও স্বেচ্ছাচারী বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় ।
৯। পৌরাণিকরা মূল গ্রন্থ ব্যতীত অন্যাদি পৌরুষেয় গ্রন্থ বিরোধী বচন থাকলেও স্বীকার করে এবং মূল গ্রন্থের অপব্যাখ্যা করে । আব্রাহামিকরাও তাদের ঐশ্বরিক গ্রন্থ ব্যতীতও অন্যাদি পরবর্তীকালে রচিত অবৈজ্ঞানিক পরস্পরবিরোধী গ্রন্থকে সম প্রামাণ্য ভাবে ৷
১০। বৈদিক সনাতন ধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও পৌরাণিকরা নামে মাত্র এক ঈশ্বর স্বীকার করেও বহুশ্বরবাদী । তারা একেশ্বরবাদকে আব্রাহামিক মত বলে কটাক্ষ করলেও যেমন তারা একেশ্বরবাদ বলেও ত্রিদেব বা অন্যাদি দেব অবশ্য স্বীকার্য বলে তেমনি আব্রাহামিক যবনরাও তাদের মত গ্রহণবাক্য [ যেমন কালেমা ] স্বীয় সৃষ্টিকর্তার পাশাপাশি দূতদের নাম নেওয়া অনস্বীকার্য বলে মনে করে এবং উক্ত নামের স্বীকৃতি ব্যতীত তাদের মতবাদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না ।
১১। পৌরাণিকরা জোড়া মানব-মানবী বিশ্বাস করে আব্রাহামিকরাও বিশ্বাস করে ।
১২। পৌরাণিক সৃষ্টিকর্তা অভিশাপ প্রদান করে তেমনি আব্রাহামিক স্রষ্টাও অবিশ্বাসীদের প্রতি ' গজব ' প্রদান করে ।
১৩। আব্রাহামিকরা বিশ্বাস করে একবার তওবা বা শপথ করলেই সব থেকে মুক্তি তেমনি পৌরাণিকরাও ভুলে নাম নিলেও [ তাৎপর্য জ্ঞাত না হয়েও ] মুক্তি সুনিশ্চিত বলে মিথ্যা মাহাত্ম্য প্রচার করে ।
১৪। উভয় দলই প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাকে যেমন সূর্য চন্দ্র গ্রহণ , গ্রহ বিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞান , মানব দেহ বিজ্ঞান সম্পর্কে হাস্যকর অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা পরিপালন করে ৷
১৫। পৌরাণিকরা ভূত - প্রেত ইত্যাদির অস্তিত্ব স্বীকার করে ও নানারকম মারণ উচাটন বশীকরণ ব্যবহার করে । আব্রাহামিকরাও জ্বীন স্বীকার করে ও একইরকম ব্যবসা চালায় ।
এতো সামান্য কিছু সাদৃশ্য মাত্র । শীঘ্রই বাকি সকল সাদৃশ্যও প্রকাশ করা হবে । এছাড়াও এখানে উল্লেখিত প্রতিটা পয়েন্ট পৌরাণিকদের প্রামাণ্য গ্রন্থ ও আব্রাহামিকদের পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি সহ উল্লেখ করে পৃথক পৃথক নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে ।
অলমিতি ।
- সারসংক্ষেপঃ
Tags
তুলনামূলক আলোচনা

