হাঁটা - দৌড়ানো বা কাজ করতে করতে মালায় জপ কতটা ঠিক ?

⚡ দেখুন তো ইস্কনীদের এই যথাতথা মালা হাতে জপ সম্পর্কে তাদের শাস্ত্রই কি বলে ❓ হাঁটা - দৌড়ানো বা কাজ করতে করতে মালায় জপ কতটা ঠিক ❓
 
আসুন উত্তর দেখি বৈষ্ণবদের হরিভক্তিবিলাসের ১৭শ উল্লাস থেকে । সংস্করণ অনুযায়ী শ্লোকসংখ্যা আগে পরে হতে পারে । আমরা চৈতন্য গৌড়ীয় মঠ প্রকাশিত সংস্করণ অনুসরণ করবো ।
১। জপ ৩ প্রকার - বাচিক, উপাংশু ও মানস। বাচিক স্পষ্টভাবে, উপাংশু কেবল নিজে কানে শুনবে আর মানসজপ মনে মনে হবে। সিদ্ধিকামীরা মানস, পুষ্টিকামীরা উপাংশু ও মারণ-উচাটনে বাচিক জপ । [ ১৫৫-১৬৩ ] 
 
২। মানস জপে দেশ ও কালভেদ নাই সব অবস্থায় করা যায় [ ১৬১-১৬২ ]। কিন্তু মালায় জপ মানস না মনে মনে বললেও কেননা টীকায় আছে 'মন্ত্রৈকশরণ ইত্যনেন পুরশ্চরণাদিস্তু' অর্থাৎ এখানে একমাত্র মন্ত্রাশ্রিত [ মালার কথা বলা হচ্ছে না - ১৬২ ] ব্যক্তির জন্যই এটা৷
 
৩। ১৩০-৩১ অনুযায়ী প্রকাশ্যে মালা জপ করলে ভূত-প্রেত জপের ফল নিয়ে যায় । 
 
৪। মালা জপের সময় নারী, কুকুর, চণ্ডাল, শূদ্র,গাধা, রজঃস্বলা এদের সাথে কথা বলা যাবে না । হাঁটতে হাঁটতে, গাড়িতে চড়ে, জুতা পায়ে, কথা বলতে বলতে, গায়ে জামা - মাথায় পাগড়ী, অঅন্যমনস্ক হয়ে, ক্ষুধার্তাবস্থায়, শুয়ে, পা ছড়িয়ে, দাঁড়িয়ে, হাসতে হাসতে, পায়ে পায়ে বা হাতে হাতে ঠোকাঠুকি করতে করতে, শ্মশানে, চুল খোলা অবস্থায়, হাই বা হেঁচকি তুলতে তুলতে জপ করা যাবে না। [ ১৩২-১৪৬ ] 
 
এখানে যারা বিড় বিড় করে জপ করেন তারা কিন্তু মানস করছেন না। আর মানস করলে সেখানে অন্যাদি উপকরণ লাগে না। কেননা স্পষ্টভাবে মূল শ্লোকে 'ধিয়া' ও বাংলাতে লেখা আছে বুদ্ধি দ্বারা এই জপ হয়, মালায় না। যদি মালা অভিপ্রেত হয় তবে উপাংশু জপ কি বুদ্ধিহীনরা করে থাকে? 
 
সুতরাং মালায় জপ করতে করতে রাস্তাঘাটে বিড় বিড় আর হাতে থলে নিয়ে কপালে বৈকুণ্ঠে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে মহাধার্মিক সাজারা কতটা ভ্রান্ত নিজেরাই বুঝে নিন ।
 
আরেকটি সংস্করণ থেকেও অনুবাদ তুলে ধরা হলো, 
 
অতঃপর জপ-বিষয়ক দোষসমূহ ব্যক্ত হইতেছে।—
 
নারদপঞ্চরাত্রে লিখিত আছে, অপবিত্র হস্তে (কুশরহিত হস্তে), নগ্নাবস্থায়, প্রাবৃত-মস্তকে এবং বাক্‌প্রয়োগ করিতে করিতে জপ করিলে তাহা বিফল হইয়া যায়।৫৯। | 
 
আরও লিখিত আছে, কথা কহিতে কহিতে, গমন করিতে করিতে, শয়নাবস্থায়, অপর কোন বিষয় চিন্তা করিতে করিতে অথবা ক্ষুৎ (হাঁচি), জম্ভণ (হাই) ও হিক্বাদি দ্বারা ব্যাকুলমনা হইয়া জপ করিলে মন্ত্রসিদ্ধির সম্ভব নাই; সুতরাং জপকালে এতৎ সমস্ত ত্যাগ করিতে যত্নবান হইবে। আরও লিখিত আছে, জপকালে নারীজাতি বা শূদ্রের সহিত কথোপকথন করিতে নাই এবং নিশাভাগেও জপ করিবে না। ব্যাসস্মৃতিতে লিখিত আছে, অঙ্গুল্যগ্রে জপ করিলে, মেরু লঙ্ঘন পূর্ব্বক জপ করিলে অথবা বিনা সংখ্যায় জপ করিলে তাহা বিফল হইয়া থাকে। বৈশম্পায়নসংহিতায় লিখিত আছে, একবসনধারী হইয়া জপ করা পুরশ্চরণকারীর অকর্ত্তব্য, বহুবস্ত্রেও আকুল হইতে নাই; পরিধেয় ও উত্তরীয় বসন ব্যতীত আর সমস্ত বহিাসন ত্যাগ করিবে।৬০। 
 
মন্ত্রার্ণবে | লিখিত আছে, উষ্ণীধারী বা কঞ্চুকধারী হইয়া, নগ্ন হইয়া, মুক্তকেশ হইয়া এবং গলদেশে বস্ত্রাদি প্রাবরণপূর্ব্বক জপ করিতে নাই; অশুচি হস্তে, শৌচাদিবিহীন হইয়া ও বাকপ্রয়োগ করিতে করিতেও জপ করা নিষিদ্ধ।৬১।
 
কর আবরণ না করিয়া, শিরোদেশ আচ্ছাদিত করিয়া, চিত্তিতমনা হইয়া, রুষ্ট, ভ্রান্ত বা ক্ষুধার্ত্ত হইয়া, আসনোপরি উপবিষ্ট হইয়া, শয়ন করিয়া অথবা গমন করিতে করিতে, দণ্ডায়মান হইয়া, উচ্চপথে স্থিত হইয়া  এবং শ্মশানাদি অশুভ স্থলে বা অন্ধকার প্রদেশে জপ করা অকর্তব্য। পাদুকাধারণ পূর্ব্বক, যানারূঢ় বা শয়ান অবস্থায়, চরণ প্রসারণ করিয়া এবং উৎকটাসনে বসিয়াও জপ করিবে না।৬২।
 
যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতায় লিখিত আছে, সমস্তাৎ ভ্রমণ করিতে করিতে, হাস্য করিতে করিতে, পার্শ্বভাগে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে, অনাশ্রয় স্থলে, বাক্ প্রয়োগ করিতে করিতে অথবা শিরঃপ্রদেশ আবরণ পূর্ব্বক জপ করা নিষিদ্ধ।৬৩। 
 
হস্ত দ্বারা হস্ত বা পদ দ্বারা পদ আক্রমণ পূর্ব্বক জপ করিবে না এবং চপলচিত্তে বা সন্দিগ্ধমনেও জপ করিতে নাই।৬৪।
 
জপ-সময়ে মনে মনে মন্ত্র চিন্তন করিবে, জিহ্বা বা ওষ্ঠ চালনা করিতে নাই, শিরোদেশ ও গ্রীবাদেশ কম্পিত করিবে না এবং দশনবিকাশ করাও নিষিদ্ধ।৬৫। 
 
প্রকাশ্যভাবে জপ করা অনুচিত, কেননা, তদ্রূপ করিলে সেই জপ যক্ষ, রক্ষ, ভূত, সিদ্ধ, বিদ্যাধর ও দেবগণ কর্তৃক সবলে অপহৃত হয়। জপ-সময়ে নারী, শূদ্র, পতিত ব্যক্তি, রাসভ' ও রজঃস্বলা—ইহাদিগকে দর্শন বা তাহাদের সহিত কথোপকথন করিবে না। ব্রত হোমাদিকৰ্ম্মকালেও উহাদিগের সহিত সম্ভাষণ নিষিদ্ধ।৬৬ 
 
ত্রৈলোক্যসম্মোহনতন্ত্রে লিখিত আছে, জপকালে বিভীতক (বহেড়া) ও করঞ্জ (করম্চা) বৃক্ষের ছায়া আক্রমণ করা সুধী ব্যক্তির অকৰ্ত্তব্য। যতক্ষণ জপ করিবে, তন্মধ্যে কোন ব্যক্তিকে কিছুই দান বা কোন ব্যক্তির নিকট কিছু গ্রহণ করিতে নাই।অনন্তর জপকালে দোষের প্রায়শ্চিত্ত বিবৃত হইতেছে।—জপকালে মৌনভাবে উপবেশন করিতে হয়, তৎকালে চণ্ডাল বা পতিত ব্যক্তিকে হঠাৎ দর্শন করিলে আচমন করিবে, তাহাদিগের সহিত কথোপকথন করিলে স্নানান্তে পুনরায় জপে প্রবৃত্ত হইতে হয়। যদি জপকালে মল-মূত্রাদি দৃষ্টিপথে নিপতিত হয়, তাহা হইলে আচমন করিয়া পুনর্জপে সযত্ন হইবে।৬৭। 
 
আরও লিখিত আছে, জপ করিতে করিতে কোনরূপে বিহিত নিয়মের ভঙ্গ হইলে বিষ্ণুনামাত্মক মন্ত্র বা অব্যয় হরিকে স্মরণ করিবে।৬৮। 
 
মন্ত্রার্ণবে লিখিত আছে, জপকালে পতিত ও অন্ত্যজগণকে দেখিলে বা তাহাদিগের সহিত কথোপকথন করিলে অথবা তাহাদিগের বাক্য শ্রুতিপ্রবিষ্ট হইলে এবং ক্ষুৎ, অধোবায়ুত্যাগ ও জুম্ভণ হইলে জপ ত্যাগ করিতে হয়। ৬৯। 
 
পতিত ও অস্ত্যজগণকে দেখিলে আচমনান্তে প্রাণায়াম ও ষড়ঙ্গন্যাস করিবে কিম্বা আদিত্যদর্শন পূৰ্ব্বক জপ সমাপন করিবে। ৭০। 
 
জপকালে মার্জ্জার, কুক্কুট, বক, কুক্কুর, শূদ্র, রাসভ ও বানর দৃষ্টিপথে পতিত হইলে আচমন করিতে হয় এবং উহাদিগকে স্পর্শ করিলে স্নানান্তে পুনরায় জপে প্রবৃত্ত হইবে। ৭১। 
 
নারদপঞ্চরাত্রে লিখিত আছে, জপকালে যদি একবারমাত্র শব্দ উচ্চারিত হয়, তাহা হইলে প্রণব উচ্চারণ করিবে; কথা কহিলে বারৈক প্রাণায়াম কৰ্ত্তব্য; বহুবাক্য প্রয়োগ হইলে আচমনান্তে অঙ্গন্যাস পূর্ব্বক জপে প্রবৃত্ত হইবে এবং ক্ষুৎ  বা দেহের কোন অস্পৃশ্যস্থল সৃষ্ট হইলে ঐরূপ করিয়া জপে প্রবৃত্ত হইতে হয়। অন্যত্রও লিখিত আছে যে, যদি মালার সূত্র জীর্ণ হয়, তাহা হইলে পুনরায় সূত্র গ্রন্থন পূৰ্ব্বক শতধা জপ কৰ্ত্তব্য; অনবধানতা-নিবন্ধন | মালা করভ্রষ্ট হইলে একশত অষ্টধা জপ করিবে এবং পূর্ব্ববৎ নিষিদ্ধ-পৃষ্ট হইলে পূর্ব্বোক্ত মন্ত্র পাঠ ও পঞ্চগব্যাদি দ্বারা ধৌত করত একশত অষ্টবার জপ করিতে হয়।৭২।

  • হরিভক্তিবিলাস ১৭।৫৬-৭৯
 



Post a Comment

Previous Post Next Post

যোগাযোগ ফর্ম